- গোরক্ষনাথ মন্দির, কূপ ও শিলালিপি
রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে
গোরকুই নামের একটি গ্রাম। নাথগুরু গোরক্ষনাথের সাথে গ্রামের নামটি স্মৃতি
বিজড়িত। এই গ্রামে নাথ আশ্রমে পাঁচটি মন্দির ও একটি ব্যতিক্রমধর্মী অতি
প্রাচীন কূপ রয়েছে। গোরক্ষনাথ নামের সাথে কূপটির নাম যুক্ত হয়ে গোরক্ষকূপ
থেকে গোরকুই নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। গোরক্ষনাথের মহিমা প্রচারে নাথ
সাহিত্যের কারণে বাংলা সাহিত্যে গোরক্ষনাথ নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গোরক্ষনাথের সময় নির্ধারণ করতে গিয়ে ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’
'গ্রন্থে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-'অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ
শতাব্দীর মধ্যে যে-কোন সময়ে তিনি মর্ত্যদেহ ধারণ করে বর্তমান ছিলেন, এমন
কথা শোনা যায়'। তাঁর আবির্ভাবের স্থান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কল্পকাহিনীর
প্রচার আছে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে গোরক্ষনাথ পেশোয়ারে আবির্ভূত হন।
গোরক্ষপন্থীদের মতে তিনি পাঞ্জাবের অধিবাসী কিন্তু পরে বিহারে বসবাস করেন।
সম্ভবত সন্ন্যাসীদের মতো অনেক জায়গা তিনি ভ্রমণ করেছেন। একটি প্রচলিত
জনশ্রুতি থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। জনশ্রুতিটি হলো-গোরক্ষনাথ এই অঞ্চলে
ইসলাম প্রচারে ফকিরদের আগমনের কথা মায়া শক্তিতে জানতে পেরে উৎকণ্ঠিত হন।
তাই তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে পশ্চিমদিক থেকে আসছিলেন। পথিমধ্যে খরস্রোতা
নোনা নদী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ বাধা তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। তিনি খড়ম পায়ে
পানির উপর হাঁটতে শুরু করেন। পূর্বে কাইচা নদীর তীরে অবস্থান করছিলেন পীর
শাহ নেকমরদ। অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি দেখতে পান গোরক্ষনাথের কেরামতি। আকাশের
দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন পীর শাহ নেকমরদ। আর এতেই অঘটন ঘটলো। গোরক্ষনাথ
নদীতে তলিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর পরনের গামছা ভিজে গেল। ধ্যানের মাধ্যমে ঘটনা
জানতে পেরে গোরক্ষনাথ আর অগ্রসর হলেন না। সেখানে বালুচর সৃষ্টি করে তিনি
বসে পড়েন। বালুচরে নাথ আশ্রম গড়ে উঠে। কিন্তু এটা শুধুই কাহিনী। কারণ পীর
শাহ নেকমরদ গোরক্ষনাথের সমসাময়িক নন। তিনি গোরক্ষনাথের অনেক পরে। তবে
গোরক্ষনাথ এই অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন না, তিনি যে ভ্রমণকারী সিদ্ধপুরুষ
সন্ন্যাসী ছিলেন এই ধারণাকে কাহিনীটি সমর্থন করে।
গোরকুই নাথ আশ্রমের মন্দির পাঁচটি কয়েক দফা সংস্কার করা হয়েছে।
সম্ভবত পুরাতন মন্দিরের উপর সর্বশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্তমান মন্দিরগুলো
নতুন করে নির্মাণ করা হয়। ইটের প্রাচীর বেষ্টিত আশ্রমটির উত্তরদিকে
দক্ষিণমুখী দরজার একটি, পূর্বদিকে পশ্চিমমুখী দরজার তিনটি এবং কূপের
প্রাচীর সংলগ্ন দক্ষিণমুখী দরজার একটি মন্দির রয়েছে।
পূর্বদিকের তিনটি মন্দিরের মধ্যে মাঝখানেরটি তুলনামূলকভাবে পাশের দুটির
চেয়ে উচ্চতায় বড়। জানা যায় এই মন্দিরটির পূর্ব দেয়ালে কালো পাথরের নরমুন্ড
বেষ্টিত খুব ছোট কালীমূর্তি আটকানো ছিল। মন্দিরের সেবায়েত জানান বাংলাদেশ
স্বাধীন হওয়ার ১২/১৩ বছর পর কে বা কারা এই
কালীমূর্তিটি নিয়ে যায়, যার সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। কালীমন্দিরটির ছাদ
অনেকটা দোচালা ঘরের মত। এর দু'পাশের মন্দির দুটিকে বলা হচ্ছে শিব মন্দির
এবং উভয় মন্দিরে একটি করে গম্বুজ রয়েছে। উত্তরের মন্দিরটিও শিব মন্দির।
'বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস' গ্রন্থে প্রত্নতাত্তিক আবুল কালাম মোহাম্মদ
যাকারিয়া কূপ সংলগ্ন মন্দিরটিকে বলেছেন 'সমাধি মন্দির'। অধ্যাপক মনতোষ
কুমার দে মনে করেন এটিই নাথ মন্দির। মন্দিরটি চারচালা বিশিষ্ট। এর দৈর্ঘ্যে
প্রস্থে পরিমাপ হলো সাড়ে এগার ফুট ও এগার ফুট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন