tag (gtag.js) --> ঠাকুরগাঁও বার্তা

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

 ঠাকুরগাঁও জেলার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

এটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা, এবং অন্যান্য জেলার মতোই এখানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকার স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো: 

১. সরকারি স্বাস্থ্যসেবা:

জেলা সদর হাসপাতাল:  ঠাকুরগাঁও জেলায় একটি আধুনিক সদর হাসপাতাল রয়েছে। এটি জেলার প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং এখানে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, জরুরি সেবা, অপারেশন, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি প্রদান করা হয়। 

 উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: প্রতিটি উপজেলায় (যেমন - ঠাকুরগাঁও সদর, পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর) একটি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এগুলোতে সাধারণ রোগের চিকিৎসা, জরুরি সেবা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান কর্মসূচি ইত্যাদি প্রদান করা হয়। 

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র:

 ইউনিয়ন পর্যায়েও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসব কেন্দ্র কাজ করে। এখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শ ও সেবা দেওয়া হয়। 

কমিউনিটি ক্লিনিক: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর  দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ সরবরাহ করা হয়।

বিশেষায়িত সেবা: সরকারি ব্যবস্থাপনায় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া (যদি থাকে), এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার জন্য বিশেষ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। 

 ২. বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা:

ক্লিনিক ও হাসপাতাল: ঠাকুরগাঁও শহরে বেশ কিছু বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এগুলোতে জেনারেল প্র্যাকটিস, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, ডায়াগনস্টিক সুবিধা ইত্যাদি প্রদান করা হয়।

ডায়াগনস্টিক সেন্টার: আধুনিক প্যাথলজি ও রেডিওলজি পরীক্ষার জন্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, যেখানে রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি ইত্যাদি সেবা পাওয়া যায়।

ফার্মেসি ও ঔষধের দোকান: শহর ও গ্রামীণ উভয় অঞ্চলেই অসংখ্য ফার্মেসি রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ পাওয়া যায়।

 ৩. চ্যালেঞ্জসমূহ:

চিকিৎসক ও নার্সের অভাব: অন্যান্য অনেক জেলার মতো ঠাকুরগাঁওয়েও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত নার্সের ঘাটতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। 

আধুনিক সরঞ্জামের অভাব: কিছু কিছু সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব থাকতে পারে, যা উন্নত চিকিৎসা প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে। * 

জনসচেতনতার অভাব: স্বাস্থ্যবিধি ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাবও একটি সমস্যা। 

৪. উদ্যোগ: সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেমন - নতুন নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ। ঠাকুরগাঁও জেলার সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার চিত্র অনেকটাই দেশের অন্যান্য জেলার অনুরূপ। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আপনার যদি ঠাকুরগাঁও জেলার কোনো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান, তবে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।



আইন শৃংখলা ও নিরাপত্তা

ঠাকুরগাঁও জেলার আইন শৃংখলা ও নিরাপত্তা:

 সাধারণত, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ বাহিনী, র‍্যাব এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাজ করে থাকে। ঠাকুরগাঁও জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। জেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়: 

 অপরাধ দমন: চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচার, নারী নির্যাতন, সাইবার ক্রাইম এবং অন্যান্য অপরাধ দমনে পুলিশ সক্রিয় থাকে। 

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা: যানজট নিরসন এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করে। 

জনসাধারণের নিরাপত্তা: বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। 

গোয়েন্দা নজরদারি:  অপরাধমূলক কার্যকলাপের উপর নজর রাখা হয় এবং প্রয়োজনে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

 সীমান্ত নিরাপত্তা:  ঠাকুরগাঁও যেহেতু সীমান্ত সংলগ্ন জেলা, তাই সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সতর্ক থাকে। 


কৃষি

ঠাকুরগাঁও জেলার কৃষি:

ঠাকুরগাঁও জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি কৃষিপ্রধান জেলা। এখানকার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর।



প্রধান ফসলসমূহ:

ধান: এটি ঠাকুরগাঁওয়ের প্রধান খাদ্যশস্য। আউশ, আমন ও বোরো - তিন মৌসুমেই ধানের চাষ হয়।  

গম: ধান ছাড়াও গম একটি গুরুত্বপূর্ণ রবিশস্য। 

ভুট্টা: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভুট্টার চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। 

আলু: ঠাকুরগাঁও আলু উৎপাদনে দেশের অন্যতম শীর্ষ জেলা। এখানে উন্নত মানের আলুর চাষ হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। 

পাট: অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের আবাদও উল্লেখযোগ্য। 

 আখ:  জেলার কিছু অংশে আখের চাষ হয়, যা স্থানীয় চিনিকলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। 

 অন্যান্য ফসল ও কৃষি পণ্য:

 তেলবীজ: সরিষা, তিল ইত্যাদি তেলবীজ ফসলের চাষ হয়। 

ডাল: মসুর, খেসারি, মুগ ডালসহ বিভিন্ন প্রকার ডালের চাষ হয়।

শাকসবজি: প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি যেমন - বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, শিম, পটল, ঝিঙা ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। 

ফল: আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, পেঁপে ইত্যাদি ফলের চাষও দেখা যায়। 

মশলা: পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ও মরিচের চাষও হয়।

কৃষি পদ্ধতি ও সেচ:

সাধারণত ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক উভয় কৃষি পদ্ধতিই ব্যবহৃত হয়। সেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপের ব্যবহার ব্যাপক। 

 কৃষি অর্থনীতিতে প্রভাব:  ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি জেলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এখানকার উৎপাদিত কৃষি পণ্য স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য স্থানেও সরবরাহ করা হয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। কৃষিভিত্তিক শিল্প যেমন - চাল কল, আটা কল, আলু হিমাগার ইত্যাদিও জেলার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষিক্ষেত্রে আরও তথ্যের জন্য, আপনি নির্দিষ্ট ফসলের উৎপাদন বা কৃষি পদ্ধতির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।



ব্যাবসা বানিজ্য

 ঠাকুরগাঁও জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য:


 জেলার অর্থনীতিতে কৃষির একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এখানকার প্রধান ফসলগুলো হলো ধান, গম, আলু, ভুট্টা, পাট এবং আখ। এই ফসলগুলি স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এছাড়াও, কিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পও এখানে গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় কর্মসংস্থানে সহায়তা করছে। 

 ১. কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ: ধানের চাতাল, আটা কল, তেল কল এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এখানে দেখা যায়। 

২. হিমায়িত খাদ্য শিল্প: আলু এবং অন্যান্য সবজি সংরক্ষণের জন্য কিছু হিমাগার রয়েছে, যা স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পেতে সাহায্য করে। 

 ৩. হস্তশিল্প:  বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র, মাটির জিনিস এবং বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পও গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখে। 

 ৪. বস্ত্র ও পোশাক শিল্প:  ছোট আকারের কিছু গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল ইউনিটও এখানে বিদ্যমান। 

. কুটির শিল্প: গ্রামীণ এলাকায় নকশী কাঁথা, পাটের তৈরি হস্তশিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পগুলি এখনও সক্রিয় রয়েছে।

 ৬. পর্যটন:  যদিও এখনও বড় আকারের পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠেনি, তবে ঐতিহাসিক স্থান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে, ঠাকুরগাঁও জেলার অর্থনীতি কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সরকারি উদ্যোগের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। 



অর্থনীতি

 ঠাকুরগাঁও জেলার অর্থনীতি:

এই জেলার মূলত কৃষিভিত্তিক।এখানকার মাটি উর্বর এবং জলবায়ু ফসল চাষের জন্য উপযুক্ত, তাই কৃষিখাতই আয়ের প্রধান উৎস। 

কৃষি: ফসল: ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পাট, আখ, শাকসবজি এবং বিভিন্ন ধরনের ডাল এখানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে আলু এবং ধান উৎপাদনে ঠাকুরগাঁওয়ের সুনাম রয়েছে। 

মৎস্য চাষ: জেলার নদী, খাল এবং পুকুরগুলিতে মাছ চাষ হয়, যা স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। 

পশুপালন: গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনও গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 শিল্প: কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প:  কৃষিনির্ভর হওয়ায় এখানে কিছু কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে উঠেছে, যেমন চাল কল, আটা কল, তেল কল এবং বরফ কল। 

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প:  বাঁশ ও বেতের কাজ, মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প এবং হস্তশিল্পের মতো ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস।

চিনি কল ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লিমিটেড জেলার অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান, যা স্থানীয় আখ চাষীদের জন্য একটি বড় বাজার তৈরি করেছে। 

ব্যবসা-বাণিজ্য:  স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্য এবং শিল্পজাত দ্রব্য কেনাবেচার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়। জেলা শহর এবং উপজেলা সদরের হাট-বাজারগুলি অর্থনৈতিক লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দু। 

 অন্যান্য খাত: শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সরকারি সেবাসমূহও জেলার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। সামগ্রিকভাবে, ঠাকুরগাঁওয়ের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হলেও ধীরে ধীরে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতও প্রসারিত হচ্ছে।


মুক্তিযুদ্ধ

 ঠাকুরগাঁও জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস:


বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পরই সারাদেশের মতো ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী জনতাও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ঠাকুরগাঁও ভৌগোলিকভাবে ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখানে মুক্তিযুদ্ধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

১. প্রতিরোধ ও প্রাথমিক যুদ্ধ:

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঠাকুরগাঁও ইপিআর (East Pakistan Rifles) এবং স্থানীয় ছাত্র-জনতা মিলে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।২৬শে মার্চের পর ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। প্রথম দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধে বেশ কিছু ছোটখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

 ২. সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধ ও সেক্টর

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও ৬নং সেক্টরের অধীনে ছিল, যার কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এম. খাদেমুল বাশার। ৬নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল বুড়িমারীতে (ভারতের অভ্যন্তরে)। এই সেক্টরের অধীনে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নীলফামারীর কিছু অংশ ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যেত এবং যুদ্ধ শেষে আবার দেশে ফিরে আসতো।

 ৩. উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ও অপারেশন:

 ঠাকুরগাঁও জেলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল এবং সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ।অনেক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ও ঘাঁটি ছিল, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে সফল হয়েছে। বধ্যভূমিগুলো আজও সেই ভয়াবহতার সাক্ষ্য বহন করে। 

 ৫. মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা:

 এই অঞ্চলের বহু মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যাদের নাম আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।  স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্রনেতা এবং সাধারণ কৃষক-শ্রমিকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন।

 ৪. শহীদ ও বধ্যভূমি:

 ঠাকুরগাঁও জেলায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শহীদ হয়েছেন। রাণীশংকৈলের খুनिया দিঘী, সদর উপজেলার শিংপাড়া বধ্যভূমি, পীরগঞ্জের ভেলাতৈড় বধ্যভূমি সহ বেশ কিছু স্থানে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। 

 ৬. ঠাকুরগাঁওয়ের বিজয়:

 ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও শত্রুমুক্ত হয়। * মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয় এবং ঠাকুরগাঁও থেকে পালিয়ে যায়। এই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের আকাশে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা উড়েছিল। ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই অঞ্চলের মানুষ অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে সহায়তা করেছিল।



আবহাওয়া ও জলবায়ু

 অবস্থান ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য:

 ঠাকুরগাঁও জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এটি হিমালয়ের পাদদেশের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া ও জলবায়ুতে এর প্রভাব দেখা যায়। এই জেলার উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলা, পূর্বে পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত। 

 সাধারণ জলবায়ু: ঠাকুরগাঁওয়ের জলবায়ু উপক্রান্তীয় মৌসুমী প্রকৃতির। এখানে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র, বর্ষাকাল প্রচুর বৃষ্টিপাত সহ আর্দ্র এবং শীতকাল শুষ্ক ও শীতল থাকে।

তাপমাত্রা:  গ্রীষ্মকাল (মার্চ-মে): এই সময়ে তাপমাত্রা সাধারণত ২৫° সেলসিয়াস থেকে ৩৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে। এপ্রিল ও মে মাস উষ্ণতম মাস। মাঝেমধ্যে তাপমাত্রা ৩৮-৪০° সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

বর্ষাকাল (জুন-সেপ্টেম্বর): এই সময়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসে, সাধারণত ২৬° সেলসিয়াস থেকে ৩১° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। 

শীতকাল:  (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি): শীতকালে তাপমাত্রা বেশ কমে যায়। দিনের বেলায় তাপমাত্রা ১৫° সেলসিয়াস থেকে ২৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে, তবে রাতের বেলায় ১০° সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে। জানুয়ারি মাস শীতলতম মাস, এ সময় তাপমাত্রা ৫° সেলসিয়াস থেকে ৭° সেলসিয়াসের মধ্যেও থাকতে পারে। মাঝেমধ্যে শৈত্যপ্রবাহের কারণে তাপমাত্রা আরও নিচে নেমে আসে এবং তীব্র শীত অনুভূত হয়।  

বৃষ্টিপাত: ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অধিকাংশ বৃষ্টিপাত হয়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০-২৫০০ মিমি। বর্ষাকালে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হয় এবং কখনও কখনও ভারী বর্ষণের ফলে বন্যাও দেখা দেয়।

আর্দ্রতা:  গ্রীষ্মকাল এবং বর্ষাকালে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে, প্রায় ৭০-৯০%। শীতকালে আর্দ্রতা কমে আসে, সাধারণত ৫০-৭০% থাকে। বায়ুপ্রবাহ সাধারণত, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকে যা প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। শীতকালে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে শীতল ও শুষ্ক বায়ু প্রবাহিত হয়। 

 ঋতুভিত্তিক বৈশিষ্ট্য:

গ্রীষ্মকাল:  উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া দিয়ে শুরু হলেও এপ্রিলের শেষ দিক থেকে বা মে মাসের শুরু থেকে কালবৈশাখী ঝড় দেখা যায়। 

 বর্ষাকাল:  জুন থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। এই সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং আবহাওয়া আর্দ্র থাকে। 

শরৎকাল(অক্টোবর-নভেম্বর): বর্ষার পর আবহাওয়া শান্ত ও মনোরম থাকে। আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আসে।

 শীতকাল:  নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে। এই সময় শুষ্ক ও শীতল আবহাওয়া থাকে। ঘন কুয়াশা পড়া ঠাকুরগাঁওয়ের শীতকালের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা কখনও কখনও দুপুরের পরেও দেখা যায় এবং জনজীবনকে প্রভাবিত করে। 

বসন্তকাল: (ফেব্রুয়ারি-মার্চ): শীতের তীব্রতা কমে আসে এবং আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:

 সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঠাকুরগাঁও জেলাতেও কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন:  বৃষ্টিপাতের ধরনে অনিয়ম, অর্থাৎ অসময়ে বৃষ্টিপাত বা কম সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত।  শীতকালের তীব্রতা বৃদ্ধি বা হ্রাস এবং দীর্ঘস্থায়ী কুয়াশা। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামা।



জেলা পরিচয়

  ঠাকুরগাঁও জেলা পরিচয়:


 জেলার পটভূমি

১৮০০ সালে বৃটিশ শাসনামলে টাঙ্গন, শুক, কুলিক, পাথরাজ ও ঢেপা বিধৌত এই জনপদের একটি ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে বর্তমান পৌরসভা এলাকার কাছাকাছি কোনো একটি স্থানে থানা স্থাপিত হয়। তাদের নাম অনুসারে থানাটির নাম হয় ঠাকুরগাঁও থানা। মতামত্মরে ঠাকুর-অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের সংখ্যাধিক্যের কারণে স্থানটির নাম ঠাকুরগাঁও হয়েছে। 

১৮৬০ সালে এটি মহকুমা হিসেবে ঘোষিত হয়। এর অধীনে ছয়টি থানা ছিলো যথা-সদর, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল, হরিপুর ও আটোয়ারী। ১৯৪৭ সালে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার ৩টি থানা ও কোচবিহারের ১টি থানা (আটোয়ারী ছাড়া পঞ্চগড় জেলার বাকি ৪টি থানা) নিয়ে ১০টি থানার মহকুমা হিসেবে ঠাকুরগাঁও নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ১৯৮১ সালে আটোয়ারী, পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ ও তেতুলিয়া নিয়ে পঞ্চগড় আলাদা মহকুমা হলে ঠাকুরগাঁও এর ভৌগলিক সীমানা ৫টি থানা এলাকায় সংকুচিত হয়ে যায়। 


থানাগুলি হচ্ছে-ঠাকুরগাঁও সদর, বালিয়াডাঙ্গী, পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল ও হরিপুর। ১৯৮৪ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারি এই ৫টি থানা নিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা যাত্রা শুরু করে। ছোট জেলা হলেও ঠাকুরগাঁও একটি প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জনপদ। এখানে যেমন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ হাজার বছর ধরে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, তেমনিভাবে বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান শাসনামলের পরিবর্তনের ছোঁয়ায় পালাবদলের প্রক্রিয়া চলছে এখানে। জেলার অতি প্রাচীন পুকুরগুলি এবং গড়গুলির অস্তিত্ব সুপ্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন তুলে ধরে। এই জেলার মানুষ বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার অন্যান্য জনপদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে।
 ১৯৭১ এর স্বাধীনতা লাভের পর বরেন্দ্রভূমির অন্যান্য জেলার মতই ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষ ক্রমান্বয়ে উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং উন্নয়নের অন্যান্য সুফল লাভে সক্ষম হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে